বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত কী কী জিনিস আনা যায়?? ব্যাগেজ রুলস-২০১৭

অনেক দিনের পুরোনো বিধিমালাকে রহিত করে বাংলাদেশ সরকার নতুন ব্যাগেজ বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। যা সবারই জেনে রাখা উচিত বিশেষ করে যারা নিত্য বিদেশে যাওয়া আসা করেন।

অর্থ মন্ত্রনালয়ের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক জুন ২, ২০১৭ তারিখের প্রজ্ঞাপনে যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ (আমদানি) বিধিমালা ২০১২ বাতিল করে নতুন বিধিমালা প্রনয়ন করেছে। এই বিধিমালা Tourist Baggage (Import) Rules, 1981 এবং Privileged Persons (Customs Procedures) Rules, 2003 এর আওতাভুক্ত যাত্রী ব্যতীত সকল যাত্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

এই বিধিমালা ’যাত্রী’ বলতে বিদেশ থেকে আসা কোন যাত্রীকে বুঝানো হয়েছে। আর ’ব্যাগেজ’ বলতে কোন যাত্রী কর্তৃক আমদানিকৃত যুক্তিসঙ্গত পরিমাণের খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয়, গৃহস্থালি বা অন্যান্য ব্যক্তিগত সামগ্রী বুঝানো হয়েছে-যার প্রত্যেকটি আইটেমের ওজন ১৫ কেজির বেশি হবে না।

নতুন বিধিমালার উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলোঃ
১. আকাশ এবং জলপথে আসা ১২ বছর বা তার বেশি বয়সের যাত্রীর সঙ্গে আনা হাতব্যাগ, কেবিনব্যাগ বা অন্য কোনভাবে আনা ব্যাগের ওজন যদি ৬৫ কিলোগ্রামের বেশি না হয় তবে সেই ব্যাগেজ সকল প্রকাশ শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই খালাসযোগ্য। অর্থাৎ ৬৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ব্যাগেজ শুল্ক ও করমুক্ত।

উপ-বিধি (১) উল্লেখিত ব্যাগেজের অতিরিক্ত ৩৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের পরিধেয় বস্তু, ব্যক্তিগত ব্যবহারের সামগ্রী, বই, সাময়িকী এবং পড়াশোনার সামগ্রী সকল প্রকার শুল্ক ও কর ছাড়াই খালাস হবে বা আনা যাবে।

২. ১২ বছরের কম বয়সী যাত্রীর ক্ষেত্রে ৪০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের কার্টন, ব্যাগ বা বস্তায় আনা ব্যক্তিগত ব্যাগেজের জন্য কোন প্রকার শুল্ক ও কর দিতে হবে না। তবে এই সুবিধা ছাড়া অন্য কোন সুবিধা ১২ বছরের কম বয়সী যাত্রী পাবে না।

৩. যাত্রীর সঙ্গে আনা হয়নি এমন ব্যাগেজ (Unaccompanied Baggage) এর ক্ষেত্রে তফসিল-১ এ নির্ধারিত ফরমে ঘোষণা প্রদান এবং এই বিধিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই খালাস করা যাবে। তবে ব্যাগেজ খালাসের সময় ঘোষণাপত্রের একটি অনুলিপি সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তার কাছে দাখিল করতে হবে।

৪. মোবাইল ফোনঃ একজন যাত্রী মোবাইল ফোন ২টি করে পণ্য সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই আনতে পারবেন।তফসিল-২ এ উল্লেখিত পণ্যের প্রত্যেকটির একটি করে পণ্য (মোবাইল ফোন ৩-৫ টি পর্যন্ত শুল্ক-করাদি (প্রায় ৩৫%) তফসিলে উল্লেখিত শুল্ক ও কর পরিশোধ করে আনতে পারবে।এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত মোবাইল ফোন Adjudication প্রক্রিয়ায় BTRC দপ্তরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদন্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

৫. সিগারেটঃ ১ কার্টন (২০০ শলাকা) পর্যন্ত সিগারেট শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত সিগারেট বিধি মোতাবেক বিক্রয়/ধ্বংসযোগ্য, তাই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।

৬. মদ/মদ জাতীয় পানীয় (হার্ড ড্রিংকস): বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী নাগরিকদের জন্য মদ আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। বিদেশী পাসপোর্টধারী নাগরিক হলে ২ বোতল বা সর্বোচ্চ ১ লিটার পর্যন্ত মদ বা মদজাতীয় পানীয় (বিয়ার, স্পিরিট ইত্যাদি) সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই আনতে পারবে। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (Detention memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত মদ বিধি মোতাবেক বিক্রয়/ধ্বংসযোগ্য, তাই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।

৭. ল্যাপটপ : ১ টি শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন। ২ টি পর্যন্ত শুল্ক-করাদি (প্রায় ২০%) পরিশোধ সাপেক্ষে আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত ল্যাপটপ পরবর্তীতে Adjudication প্রক্রিয়ায় CCI&E দপ্তরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদন্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

* কম্পিউটার মনিটরঃ ১টি ১৯” পর্যন্ত শুল্কমুক্ত। ২০”-২২” হলে প্রায় ৫০%, ২৩” বা তার বেশি হলে প্রায় ৭০% শুল্ক।

৮. টেলিভিশন : ২১” পর্যন্ত শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন। ২২”-২৯” হলে ৫,০০০ টাকা, ৩০”-৩৬” হলে ১০,০০০ টাকা, ৩৭”-৪২” হলে ২০,০০০ টাকা, ৪৩”-৪৬” হলে ৩০,০০০ টাকা, ৪৭”-৫২” হলে ৫০,০০০ টাকা, ৫৩” -৬৫” হলে ৭০,০০০ টাকা এবং ৬৬” এর বেশি হলে ৯০,০০০ টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।

৯. স্বর্ণালংকার : ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালংকার অথবা ২০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের রৌপ্যের অলঙ্কার সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই (এক প্রকারের অলংকার ১২ টির অধিক হবে না) আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে অতিরিক্ত প্রতি গ্রাম এর জন্য প্রায় ১,৫০০ টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। বাণিজ্যিক পরিমান বলে মনে হলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (detention memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত স্বর্ণালংকার পরবর্তীতে Adjudication প্রক্রিয়ায় CCI&E দপ্তরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদন্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন। আর চোরাচালান বলে মনে হলে কাস্টমস সরাসরি ফৌজদারি মামলা করবে।

১০. স্বর্ণবার/বিস্কুট : শুল্কযুক্ত। প্রতি ১১.৬৭ গ্রামে (১ ভরি) ৩,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এভাবে ২৩৪ গ্রাম পর্যন্ত আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত স্বর্ণ বার পরবর্তীতে Adjudication প্রক্রিয়ায় CCI&E দপ্তরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদন্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন। আর চোরাচালান বলে মনে হলে কাস্টমস সরাসরি ফৌজদারি মামলা করবে।

১১. নতুন শাড়ী/অন্যান্য কাপড়/কসমেটিক্স : ব্যাক্তিগত বিবেচনায় কয়েকটি পর্যন্ত শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন। আরও কয়েকটি শুল্ক-করাদি (প্রায় ১৬০%) পরিশোধ সাপেক্ষে আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে বাণিজ্যিক বিবেচনায় কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (Detention memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত পণ্য পরবর্তীতে Adjudication প্রক্রিয়ায় CCI&E দপ্তরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদন্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

১২. ওষুধ : জরুরী বিবেচনায় প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে কিছুটা আনতে পারবেন। বাণিজ্যিক পরিমান বলে মনে হলে কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নিবেন। আটককৃত ওষুধ পরবর্তীতে Adjudication প্রক্রিয়ায় DGDA দপ্তরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদন্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

১৩. বৈদেশিক মুদ্রাঃ বিদেশে যাওয়ার সময় পাসপোর্টে এনডোরস [বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত ক্ষেত্র ব্যাতিত] ব্যাতিত কোন বৈদেশিক মুদ্রা সাথে নিতে পারবেন না। তবে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫,০০০ টাকা পাসপোর্টে এনডোরস ছাড়াই সাথে নিতে পারবেন। সাধারণত প্রতিবার ভ্রমনে ৫,০০০ ডলার পর্যন্ত এনডোরস করিয়ে নেওয়া যায়। এনডোরস ব্যাতিত বৈদেশিক মুদ্রা সাথে নিলে কাস্টমস আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নিবেন। আর মুদ্রা পাচার বলে মনে হলে কাস্টমস সরাসরি ফৌজদারি মামলা করবে।

এছাড়া, বিদেশ থেকে ফেরার সময় ইচ্ছেমত বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারবেন।স্থলপথে আসা একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ৪০০ মার্কিন ডলার মূল্যের ব্যাগেজ সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই আমদানি করা যাবে।তবে ৫,০০০ ডলার/সমমান এর বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনলে অবশ্যই কাস্টমস এর নিকট FMJ ফরম-এ ঘোষণা প্রদান করতে হবে।

১৪. একজন যাত্রী তার পেশাগত কাজে ব্যবহারের জন্য সহজে বহনযোগ্য সকল প্রকার যন্ত্রপাতি সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই আমদানি করতে পারবে।

১৫. আকাশ, স্থল বা জলপথে আসা একজন অসুস্থ, পঙ্গু বা বৃদ্ধ যাত্রীর ব্যবহারের জন্য চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বা হুইল চেয়ার আনার জন্য কোন প্রকার শুল্ক ও কর দিতে হবে না।

১৬. এই বিধিমালায় যাই থাকুক না কেন, কোন বাংলাদেশী নাগরিক বিদেশে মৃত্যুবরণ করলে তার ব্যাগেজ সকল প্রকার শুল্ক ও কর থেকে অব্যাহতি পাবে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ

☘ সাময়িক আটকঃ শুল্ক-করাদি পরিশোধ সাপেক্ষে খালাসযোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক শুল্ক-করাদি পরিশোধ করার মত টাকা সাথে না থাকলেও ভয়ের কিছু নেই। সেক্ষেত্রে কাস্টমস তা সাময়িকভাবে আটক করবে। আটক রশিদ (Detention Memo) বুঝে নিবেন। সাময়িকভাবে আটককৃত পণ্য ২১ দিনের মধ্যে যথাযথ শুল্ক-করাদি পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

☘ এ-ফরম (তফসিল-১ ফরম) ঘোষণাঃ সকল যাত্রীর জন্য কাস্টমস ঘোষণাপত্রের বিধান করা হয়েছে। বিদেশ থেকে আসার আগে কার্গোতে ব্যক্তিগত মালামাল বুকিং দিয়ে আসলে বাংলাদেশে নেমেই/৭ দিনের মধ্যে এয়ারপোর্ট কাস্টমস এর নিকট এয়ারওয়ে বিল এবং পাসপোর্টসহ উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত “এ-ফরম” পূরণ করে মালামাল এর ঘোষণা প্রদান করবেন। অনুমোদিত “এ-ফরম” এর কপি নিয়ে মালামাল আসার পর শুল্ক-করাদি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) পরিশোধ সাপেক্ষে এয়ারফ্রেইট ইউনিট থেকে মালামাল নিতে পারেন।

 অপরিচিত ব্যাক্তি এবং ব্যাগেজ-কে বিশ্বাস করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই না জেনে অন্য কারো দেওয়া মালামাল বহন করবেন না।

ব্যাগেজ সংক্রান্ত নতুন বিধিমালা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আছে নিচের ঠিকানায়ঃ-
http://www.nbr.gov.bd/contents/rule/9.pdf এই ঠিকানায় গেলে তফসিল-১ এ ব্যাগেজ ঘোষণা ফরম, তফসিল-২ ও ৩ এ কোন পণ্য কি পরিমাণে শুল্ক ও করমুক্তভাবে আনা যাবে তার তালিকা এবং তফসিল-৪ সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয়ের বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

(ভুলত্রুটি সংশোধনী)